Tuesday, August 5, 2025
প্রধান পাতাবাংলাদেশদেশে শেখ হাসিনার শেষ ৪৫ মিনিট

দেশে শেখ হাসিনার শেষ ৪৫ মিনিট

ঠিক এক বছর আগের এই দিনে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে একপ্রকার বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছিলেন, তা ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। গত বছরের এই দিনে যেমন ওই ঘটনা আবেদন ছড়িয়েছিল, এক বছর পর আজও সেদিনের সেই প্রকৃত প্রেক্ষাপট জানার কৌতূহল একইরকম রয়ে গেছে সাধারণ মানুষের।

সেদিন দেশজুড়ে জারি ছিল কারফিউ। আগের রাতে (রোববার) নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বৈঠকে সেই কারফিউ কঠোরভাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে ছাত্রদের মধ্যে রব উঠেছিল কারফিউ ভাঙার। ৫ আগস্ট সোমবার পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়ে ওঠে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তলব করেন। শুরু হয় বৈঠক, সেখানেই তিনি প্রথম জানলেন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তার হাতে আর সময় নেই, কারণ সবই তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন নিজ হাতে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে; কিন্তু সময়ের নির্মমতায় তিনি সেই সময়টুকুও পাবেন না বলে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে জানায়। তার জন্য বরাদ্দ মাত্র ৪৫ মিনিট, কারণ আন্দোলনের ঢেউ গণভবন পর্যন্ত পৌঁছাতে এরচেয়ে বেশি সময় লাগবে না। শেষমেশ বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর দিয়ে সহোদর বোন শেখ রেহানাসহ ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চারদিকে আন্দোলনের প্রবলতা মোকাবিলায় ৫ আগস্ট দিনের আলো ফোটার কয়েক ঘণ্টা পরই শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক ডেকেছিলেন। সে অনুযায়ী সকাল ১০টায় তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত হন গণভবনে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বৈঠকে বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ দেন আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করতে। তবে তারা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন যে, পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ সময় তিনি কর্মকর্তাদের প্রতি রুষ্ট হন এবং বাস্তব পরিস্থিতি মানতে নারাজ ছিলেন।

জানা গেছে, প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে রোববার রাতেই তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ দায়িত্বশীল কয়েকজন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এমনকি পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিলেও সেটা সংবিধানসম্মত নয় বিধায় তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। বরং ৫ আগস্ট সকাল থেকে কারফিউ আরও কড়াকড়ি করতে বলেন। ভোর থেকে কারফিউ কড়াকড়িভাবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সকাল ৯টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীরা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামতে শুরু করেন। ১০টা নাগাদ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জমায়েত বড় হতে থাকে। উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকায় কিছুটা প্রতিরোধের মুখে পড়লেও আন্দোলনকারীদের স্রোতের কাছে তা ছিল নস্যি, বরং কারফিউ ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হয়নি, উল্টো রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশের ব্যারিকেড তুলে ফেলা হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক ফলপ্রসূ না হলে বিকল্প পথের চিন্তা করেন কর্মকর্তারা। তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে আরেক কক্ষে আলোচনায় বসেন তারা। তাকে পরিস্থিতি জানিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা এরপর বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন; কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চান। অবশ্য কর্মকর্তারা তাতে সায় দেয়নি। শেখ রেহানা বারংবার চেষ্টা করলেও বড় বোন শেখ হাসিনা দেশত্যাগে অনড় ছিলেন। একপর্যায়ে বিদেশে অবস্থানরত ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন। এরপর মা শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে রাজি করিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন ছেলে জয়।

কিন্তু তখনো নতুন এক শর্ত দেন শেখ হাসিনা। দেশ তিনি ত্যাগ করবেন; কিন্তু তার আগে একটি ভিডিও ভাষণ রেকর্ড করার সময় দিতে হবে, যা জাতির উদ্দেশে প্রচার করতে হবে। তৎক্ষণাত শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, শাহবাগ থেকে জনস্রোত গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে গণভবন পর্যন্ত আসতে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট লাগবে। সুতরাং শেখ হাসিনার হাতে আর মাত্র ৪৫ মিনিট সময়। জীবননাশের ঝুঁকি এড়িয়ে দেশ ছাড়ার জন্য এর চেয়ে বেশি সময় পাবেন না তিনি।

আরও জানা গেছে, শেখ হাসিনা যাতে নিরাপদে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেন, সেজন্য ব্যবস্থা থাকলেও তার বহরে হামলা হতে পারে–এমন উদ্বেগ ছিল। তাই, সড়কপথের পরিবর্তে একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। এরপর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সেই হেলিকপ্টারে চড়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে আসেন শেখ হাসিনা। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয় বিমানে।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, ‘মা (শেখ হাসিনা) চেয়েছিলেন, আমার খালা (শেখ রেহানা) চলে যাক। আমার মা হেলিকপ্টারে উঠতে চাননি। আমি ফোন করেছিলাম। আমি আমার মাকে রাজি করাচ্ছিলাম। আমার খালাকে বলেছিলাম, তাকে চলে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত তারা তা করেন।’

দ্রুতই খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। আর এ খবরে গণভবনে ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনস্রোত। শেখ হাসিনা তার যেসব জিনিস রেখে যান, তার অনেক কিছুই গণভবনে ঢুকে পড়া জনতা নিয়ে যায়। এমনকি এই হামলার সময় তিনি মাঝ–আকাশেই ছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে উড়োজাহাজটি দিল্লির কাছে একটি বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ