৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯। আমি তখন সদ্য ক্যাপ্টেন হয়েছি, Adjutant, 18 Engineers Battalion, 14 Independent Engineers Brigade, Dhaka Cantonment.
আমাদের ইউনিট ১৮ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন থেকে জানানো হল যে আমরা আজ পিলখানার ভিতর প্রবেশ করব, আটকে পড়া সেনাবাহিনীর পরিবার গুলিকে উদ্ধার করার জন্য। এমনকি আমাকে আমার সিনিয়র ইউনিট অফিসার মেজর মাহবুব স্যার পুরো পরিকল্পনা ব্রিফ করলেন।
সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫ টা অবধি আবাহনী মাঠে অপেক্ষা করছি কখন আদেশ আসবে ভিতরে যাবার। আমরা অস্ত্র, প্রাণ নিয়ে প্রস্তুত ভিতরে যেতে। বাসায় মিথ্যা বললাম যে, ইউনিটেই আছি, নিরাপদ আছি। (শুধু আশরাফ কে সত্যি বলেছি, বড় আপা, শশুর আব্বাকে মিথ্যা বলেছি)।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেনাবাহিনী চীফ মইন ইউ. আহমেদ স্যার কোন আদেশ দিলেন না। (তারা নাকি বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করছেন!) এর মাঝে আরও ভাবীরা সম্মান হারালেন, প্রাণ হারালেন আরও অফিসার।
সন্ধ্যায় নাটকীয় ভাবে পিলখানার ভিতরে বিদ্যুৎ লাইন কেটে, গেট খুলে খুনী দের পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হল। হাজারীবাগ এর দিকে র্যাব এর অফিসার ( আমার ভুল না হয়ে থাকলে Lt. Col Ashik Sir, Engineers, তখন ক্যাপ্টেন ছিলেন ) খুনীদের পালাতে দেখে কয়েকটাকে ধরে র্যাব এর গাড়িতে করে ধরে নিয়ে আবাহনী মাঠে আসলেন। আমার ঠিক সামনেই ততকালীন ডি,জি, ডি জি এফ আই আশিক স্যারকে ধমক দিলেন, তোমাকে আদেশ ছাড়া কে এদের ধরতে বলেছে? ( As if, তাদের তো পালানোর কথাই ছিল, আর সেটা নিশ্চিত করা উনার দায়িত্ব ছিল!)
যাই হোক, এখন তো আর এত অফিসার এর সামনে এদের ছেড়ে দিতে পারেন না! উনি বলেন এদের পুলিশের বাসে উঠিয়ে দাও, তারা যা করার করুক। হঠাৎ আমাকে ডেকে আদেশ করা হল আমি যাতে পলায়নপর এই খুনীদের এক সিরিয়াল এ বসিয়ে তাদের ব্যাগ চেক করি। আমার জন্য আদেশ ধাতব কোন কিছু থাকলে ফেলে দিয়ে ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠান। আমি আমার রানার সৈনিক আনোয়ার এবং আরেক সৈনিককে নিয়ে ব্যাগ চেক শুরু করলাম।
ব্যাগে দামী দামী শাড়ি, জুয়েলারি। প্রায় প্রত্যেক এর ব্যাগেই। আমি তখন এতই নাইভ যে বুঝি নাই এরা লুট করছে। আমি অবাক হয়েছি। কয়েক বি ডি আর সৈনিককে জিজ্ঞেস করলাম – তোমার ব্যাগে এতগুলো শাড়ি কেন? সে বলল – স্যার ছুটি যাব তো, বউএর জন্য কিনেছি!
যেহেতু ধাতব কিছু নেয়া নিষেধ, আমি জুয়েলারি গুলি একসাথে করে মাঠের পাশের ডাস্টবিন এ ফেলে দিলাম। বাকি কাপড়, শাড়ি ফেরত দিয়ে তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম। এই ঘটনার অনেকদিন পর আমি বুঝেছি যে, সেগুলি আসলে সোনার গয়না ছিল!
গত ১৫ বছর মূক ছিলাম। আজ ঘুরেফিরে পুরাতন কথা মনে পড়ছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
উল্লেখ্য বি ডি আর ঘটনার পর ২৭ ফেব্রুয়ারী আমি সেনাবাহিনীতে Resignation ( Appendix K ) জমা দিয়ে চলে আসি। আমি আমার Resignation এ কারণ উল্লেখ করি যে
I am highly Demotivated to serve anymore after this incident as we could not save our brother officers.
সেনা সদর দপ্তরে এবং নিজ ইউনিটে বেশকিছু
“Motivation Interview ” হয় আমার যাতে আমি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি। কিন্তু আমার আবেগ অথবা বিবেক কোনটাই সায় দেয় নি। শেষমেষ শুনলাম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বলা হয়েছে – তারা আমাকে ছাড়বে, কিন্তু আমার রেজিগ্নেশন এর যে কারণ আমি দেখিয়েছি তা পরিবর্তন করতে হবে।
আমি অনেক রাগ,বিরাগের পর বুঝলাম যে, এই
“কারণ” চেঞ্জ না করলে আমাকে সেনাবাহিনীতে রেখেই Torture করবে।
সি ও স্যার ( Lt. Colonel Mahfuz sir) বললেন – চলে যেতে আসলেই যদি চাও, নিজেকে কস্ট দিও না।
আমি ” নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা ” লিখে পরিবর্তন করলাম, ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই আমাকে এস,ও,ডি (সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি) দেয়া হল।
গতকাল সেই গণভবণ থেকে ঠিক একইভাবে জণগণ তার শাড়ি লুট করে নিয়ে ছবি দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছি।
ইতিহাস ফিরে আসে। সে আমাদের মনের মত নরম না। সে খুবি শক্ত।