Thursday, November 7, 2024
প্রধান পাতাবাংলাদেশবাংলাদেশে স্পাইওয়ারের ছায়াঃ আওয়ামী লীগ সরকারের ভার্চুয়াল গোয়েন্দা

বাংলাদেশে স্পাইওয়ারের ছায়াঃ আওয়ামী লীগ সরকারের ভার্চুয়াল গোয়েন্দা

আপনার স্মার্টফোন, যা আজকাল আমাদের সব সময়ের সঙ্গী, একটি ভাচুয়াল গোয়েন্দার মতো কাজ করতে পারে। এটি ক্যামেরার মাধ্যমে সবকিছু নজরদারি করে, ফোনের কথোপকথন শোনে, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, টেক্সট, ভয়েস কল এবং ছবি—সবকিছু মনিটর করে। বিশেষ কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকার যদি কাউকে গোপন নজরদারি করতে চায়, তারা স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও পরিচিত হ্যাকিং সফটওয়্যার হল পেগাসাস, যা মূলত সরকারবিরোধী দল, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও অন্যান্য ব্যক্তিদের নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয়।  অভিযোগ আছে বাংলাদেশে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারসহ বিভিন্ন সংস্থা পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে। গণতন্ত্রবিরোধী দমন নীতির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার এমন নজরদারির কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে বলে মনে করা হয়।

পেগাসাস কী এবং কেন এটি এত বিপজ্জনক?

পেগাসাস একটি স্পাইওয়্যার বা গোয়েন্দা সফটওয়্যার যা ইসরায়েলি সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি NSO গ্রুপ দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। এটি স্মার্টফোনে প্রবেশ করে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, যোগাযোগ এবং ডিভাইসের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম। পেগাসাস এত বিপজ্জনক কেননা এটি ব্যবহারকারীর ফোনের সমস্ত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারে, যেমন কল, মেসেজ, ইমেইল, এবং এমনকি ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং সংবেদনশীল তথ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

এছাড়াও, পেগাসাস একাধিক নিরাপত্তা হোল ব্যবহার করে ইনস্টল করা হয় যা সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য আবিষ্কার করা কঠিন। এটি সরকারী এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং সাধারণভাবে নাগরিকদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে।

প্রমাণ ও অভিযোগ

২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কানাডিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিটিজেন ল্যাব বাংলাদেশে পেগাসাস স্পাইওয়্যার সক্রিয় থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু প্রমাণ আবিষ্কার করে। তারা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত কিছু সার্ভারের সন্ধান পায়, যা স্পাইওয়্যার দ্বারা সংক্রমিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রমাণগুলো বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) কে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে, যা দেশে ব্যাপক নজরদারির আশঙ্কা সৃষ্টি করে।

যদিও বাংলাদেশ সরকার পেগাসাস ক্রয় বা ব্যবহার করার কথা অস্বীকার করেছে, তবে বিশ্বজুড়ে পেগাসাসের ব্যবহার ইতিমধ্যে একাধিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, পেগাসাস বিভিন্ন দেশের সরকার দ্বারা সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এনএসও গ্রুপ দাবি করে যে তাদের সফটওয়্যার কেবলমাত্র বৈধ সরকারি সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি করা হয়, কিন্তু বিভিন্ন তদন্ত প্রমাণ করেছে যে এটি প্রায়শই রাষ্ট্রের বিরোধীদের ওপর অবৈধভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এনটিএমসি-এর ভূমিকা

বাংলাদেশের জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) দেশের টেলিযোগাযোগ নজরদারি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।  এনটিএমসি দেশের সকল মোবাইল ফোন, টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (ISP) তথ্য ও যোগাযোগের উপর নজরদারি করে। এই সংস্থাটি টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ অনুযায়ী কাজ করে এবং তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করা, জঙ্গি কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা এবং অপরাধ দমন করা।  এনটিএমসি-এর কার্যক্রম নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং বিরোধী দল ও সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ এনটিএমসি-এর কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।  যদিও সরাসরি পেগাসাস ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে এনটিএমসি যোগাযোগ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা রাখে, যা এই ধরনের উন্নত স্পাইওয়্যার ব্যবহারের সম্ভাবনা জাগায়।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে এনটিএমসি একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যাতে এটি শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ একমাত্র দেশ নয় যেখানে এই অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বব্যাপী পেগাসাসের ব্যবহার ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে সমালোচকদের নীরব করতে এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে অভিযুক্ত হয়েছে। এনএসও গ্রুপ দাবি করে যে তারা কেবল সরকারি সংস্থাগুলির কাছে আইন প্রয়োগের বৈধ উদ্দেশ্যে পেগাসাস বিক্রি করে, কিন্তু প্রতিবেদনগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে সফটওয়্যারটি প্রায়ই এই উদ্দেশ্যের বাইরে ব্যবহার করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পেগাসাস বা অন্যান্য স্পাইওয়ার ব্যবহার হচ্ছে কি?

বর্তমানে বাংলাদেশে পেগাসাস বা অন্যান্য স্পাইওয়ার প্রোগ্রাম ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সরাসরি কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট এবং মানবাধিকার সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে সাইবার নজরদারি ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি উদ্বেগজনক হতে পারে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন সময় সাইবার নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনার মধ্যে এসেছে, কিন্তু পেগাসাস বা বিশেষ কোনো স্পাইওয়ার ব্যবহারের নির্দিষ্ট প্রমাণ এখনো সামনে আসেনি। তবে, সরকারের এবং নিরাপত্তা সংস্থার নিরীক্ষণ নীতি ও প্রযুক্তির দিকে নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ, এবং কোনো নতুন তথ্য পাওয়া গেলে তা জনস্বার্থে প্রচারিত হবে।

পরিশেষে

এই অভিযোগগুলো বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর ভয়ের একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে। বিরোধী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, এবং মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নজরদারি করার অভিযোগগুলো যদি প্রমাণিত হয়, তবে তা দেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।  বাংলাদেশে পেগাসাস স্পাইওয়ারের ব্যবহারের অভিযোগটি শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ। একটি উন্নত এবং কার্যকরী প্রযুক্তি যদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তবে এটি গোপনীয়তা এবং মানবাধিকারের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়ে পরবর্তী তদন্ত এবং তার পরিণতির দিকে নজর থাকবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের।

রেফারেন্স লিঙ্ক

*সিটিজেন ল্যাবের পেগাসাস স্পাইওয়্যার সম্পর্কিত তদন্ত (HIDE AND SEEK: Tracking NSO Group’s Pegasus Spyware to Operations in 45 Countries – The Citizen Lab)

*পেগাসাস সম্পর্কে বিস্তারিত (Pegasus (spyware) – Wikipedia)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ