Monday, July 7, 2025
প্রধান পাতারাজনীতিকতগুলো সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়নি বিএনপি, খতিয়ান দিলেন ফখরুল

কতগুলো সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়নি বিএনপি, খতিয়ান দিলেন ফখরুল

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় কোন কোন প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে, আর কোন কোন বিষয়ে একমত হতে পারেনি, তার পরিসংখ্যান হাজির করেছে বিএনপি।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহ ও প্রত্যাশা যেমন অনেক, তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে জনমনে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা যেমন ছয়টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে (আলোচনায়) সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি, তেমনি ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় আমাদের প্রতিনিধিগণ কার্যকর অংশগ্রহণ করে চলেছেন।”

তিনি দাবি করেন, “বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদের প্রতিনিধিরা অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছেন।”

দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবের বিপরীত কিম্বা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ায় এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।

তিনি বলেন, “ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী বলেই আমাদের প্রতিনিধিরা ধৈর্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্য প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগিতা করছেন।”

কিছু বিষয়ে বিএনপি কেন একমত হতে পারেনি, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে দলটির মহাসচিব বলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোনো প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দ্যেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।

“জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্খার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে এমন কোন প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা নয়, বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।”

পুলিশ সংস্কার কমিশন: ফখরুল বলেন, “এই কমিশনের প্রস্তাব এখনো আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে দলের নেতৃবৃন্দ যতটুকু জানিয়েছেন, তা হল, র‌্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।”

দুর্নীতি দমন কমিশন: বিএনপি মহাসচিব বলেন, কিছু ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই তার দল সম্মতি জানিয়েছে। শুধু ২৯ নম্বর সুপারিশে বিএনপি একমত নয়।

২৯ নম্বর সুপারিশে আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৩০৯ সংশোধন করে এটি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে যে, দুদকের চাওয়া কোনো তথ্যাদি বা দলিলাদির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না।

ফখরুল বলেন, বিষয়টি আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে তারা তথ্য বা দলিল চাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নেয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। তা না হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে ‘অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ’ সৃষ্টি হবে বলে তিনি মনে করেন।

জনপ্রাসন সংস্কার কমিশন: এই কমিশনের ২০৮টি সুপারিশর মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে, পাঁচটিতে আংশিক একমত হয়েছে এবং পাঁচটি সুপারিশে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বলে তথ্য দেন ফখরুল।

তিনি বলেন, “১১টি প্রস্তাবে বিএনপি একমত হতে পারেনি, যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসংগতির বিষয়। পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।”

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন: এই কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে বিএনপি একমত হয়েছে, নয়টিতে আংশিকভাবে একমত এবং ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছে বলেজানান বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সকল প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিম্বা ইতোমধ্যে কোনো অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রেটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।”

নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশন: ফখরুল বলেন, এই কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত হয়েছে, ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছে, ৬৪টিতে ‘ভিন্নমতসহ একমত’ হয়েছে।

“অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী কীভাবে অধিকতর কার্যকর হবে তা প্রস্তাব করেছে বিএনপি।”

২৪টি প্রস্তাবে বিএনপি একমত হতে পারেনি জানিয়ে ফখরুল বলেন, “নির্বাচনী ব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ছয়টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তাবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। বিএনপি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনা সকল প্রস্তাবে একমত হয়েছে।আইনি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যহত আছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন: সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফা ওয়ারি মতামত দিয়েছে এবং অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছে বলে জানান ফখরুল।

তিনি বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ–দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিএনপি সম্মত হয়েছে।

“প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও বিএনপি তাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছে। জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি সহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও বিএনপি সম্মত হয়েছে।”

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে বিএনপি সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে জানান ফখরুল।

এছাড়া তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও বিএনপি একমত হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে তারা তা বিচার বিভাগের সাথে আলোচনার মাধমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ এর আগে ১৯৮৮ সালে এরকম উদ্যোগ উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিল।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা একমত হয়েছি যেগুলোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুরূহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্নসাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সংসদীয় কার্যক্রমে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।

“ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। সংস্কার কমিশনসমূহের প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্য নতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিম্বা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি, দল কিংবা কমিশনের আছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “ প্রায় দেড় যুগ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিএনপি শুধু টিকে থাকেনি বরং অধিকতর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়েছে। শত শহীদের রক্তে, গুম, খুনের শিকার সহকর্মীদের আত্মত্যাগে আর লাখো নেতা-কর্মীর অবর্ণনীয় দুঃখ-শোকে বিএনপির ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সমর্থ্য নিয়ে এবং দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি দেশে আবারও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

“স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে আমরাই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিম্বা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়। আমরা যেন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের এই সুযোগকে গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাই এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০ এর ছাত্র গণঅভূত্থান এবং ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভুত্থানের আকাঙ্ক্ষ ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হই।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহ উদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনগুলো ২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে।

পরে সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিকে দলগুলোর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

কমিশনের প্রথম দফার আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০ মার্চ এবং তা শেষ হয় ১৯ মে। এরপর ৩ জুন থেকে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হয়ে এ পর্যন্ত ৯ দিন আলোচনা হয়েছে। জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ