Monday, August 11, 2025
প্রধান পাতারাজনীতিতারেক রহমানকে নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে কূটনীতিকদের

তারেক রহমানকে নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে কূটনীতিকদের

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দিনকে দিন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করছেন তিনি। লন্ডনে অবস্থানরত শীর্ষ এই রাজনীতিকের সঙ্গে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠকের খবর প্রকাশ্যে এসেছে, যা ঢাকার রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, তারেক রহমান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। তিনি নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন। তার বক্তব্যও এখন অনেক পরিমিত, রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন। কূটনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও তিনি মুনশিয়ানার পরিচয় দিচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার সক্রিয়তা বেড়েছে, সেখানে রাজনৈতিক বার্তার পাশাপাশি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে। সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, এ কথা সত্য যে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি আগামীতে জনগণের বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসবে। তারেক রহমান যেহেতু বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাই তার অবস্থান অনিবার্যভাবেই আলোচনায় আসবে, এটি স্বাভাবিক।

অথচ বিগত প্রায় দেড় যুগ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হেন কোনো অপপ্রচার নেই, যা করেনি। তারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপরাধ এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের নানা অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক মহলে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, মানি লন্ডারিংসহ একাধিক মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলায়। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির পালাবদলে বর্তমানে অনেক কূটনীতিকের আগ্রহের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন তারেক রহমান। যদিও তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘উপযুক্ত পরিস্থিতি’ তৈরি হলে তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। আর এই উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে দলটি। তবে তারেক রহমান চলতি আগস্টের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুতে দেশে ফিরতে পারেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও কূটনীতিকরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকা, চীন, জাপান, কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনারসহ প্রায় ত্রিশটি দেশের কূটনীতিকরা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পৃথক এসব বৈঠকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দলটির অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন।

বিএনপির এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফার ওপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপির বর্তমান অবস্থান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি আগামীতে সরকার গঠন করলে জাতীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করাসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা স্থান পায়।

বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান কালবেলাকে বলেন, বিএনপি দেশ ও জনগণের পক্ষে কাজ করে। দেশের মালিকানা দেশের জনগণের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবার মতামতের ভিত্তিতে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা দিয়েছেন। যেমনটি দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯ দফা ঘোষণা করেছিলেন। সবমিলিয়ে ৩১ দফা সামনে রেখে এগোলে বাংলাদেশ হবে একটি দৃষ্টান্ত। বিএনপি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করলে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছেন তারেক রহমান। সুতরাং আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাবে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। সেজন্যই তারা তারেক রহমানকে প্রাধান্য দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আধুনিক বিশ্বে প্রভাবশালী দেশগুলো চায় রাজনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক। তারা জানে, দমনপীড়নমুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। তারেক রহমান যেহেতু বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাই তার অবস্থান অনিবার্যভাবেই আলোচনায় আসবে।

বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দেখা করছেন, বৈঠক করছেন। যদিও এসব বৈঠক নিয়ে বিএনপির তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। এসব বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠন নিয়ে ভাবনা, দেশ গড়ার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। অতি সম্প্রতি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাতারের একজন মন্ত্রীসহ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক দপ্তরের ইন্দোপ্যাসিফিক বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট, ব্রিটিশ এমপি ক্যাথরিন ওয়েস্ট, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ দলের গবেষণা উন্নয়নবিষয়ক সাবেক পরিচালক রজ ক্যাম্পসেল, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস প্রমুখ।

জানা গেছে, এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন গত মাসের মাঝামাঝিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রায় দুই ঘণ্টার ওই বৈঠকে উভয় দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং ক্ষমতায় গেলে দেশ গড়া ও সরকার গঠন নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রসঙ্গে জানতে চান এই কূটনীতিক। বৈঠকের শুরুতে তারেক রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কুশল বিনিময় করেন। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া বৈঠকে গত ১৩ জুন লন্ডনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে তারেক রহমানের ভাবনা, পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যতে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নসহ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, বিদেশি কূটনীতিকরা এখন আর একপেশেভাবে শোনেন না। তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, নির্বাচনী রূপরেখা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চান। তার সঙ্গে এসব কূটনীতিকের বৈঠক আমাদের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।

তারেক রহমানকে নিয়ে কূটনীতিকদের আগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক গতকাল কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক মহলে তার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। কূটনীতিকদের এই আগ্রহের পেছনে প্রধান কারণ হলো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদি একটি সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে, তাহলে তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে পারেন। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নীতি (বিশেষত অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক ও শাসনব্যবস্থা) সম্পর্কে ধারণা নেওয়া কূটনীতিকদের জন্য জরুরি। এ ছাড়া কোনো দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা কূটনীতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ তাদের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি প্রস্তুত করতে চাইতে পারে। এটি বিএনপির জন্য ইতিবাচক হলেও এটি নির্ভর করবে দলটির সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর। সর্বোপরি, কূটনৈতিক আগ্রহ রাজনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হবে জনগণের রায় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ